বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০১৪

মরণ হ’তে জাগি (১)


[ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিতঃ http://www.sahityacafe.com/?p=1497]

[বহু বছর আগে ইবসেনের এই নাটকটি অনুবাদ করেছিলাম। মূলতঃ মাইকেল মেয়ার-এর ইংরেজি অনুবাদ ‘হোয়েন উই ডেড এওয়েইকেন’ থেকে। পরে বাংলা একাডেমীর সাহিত্য ত্রৈমাসিক ‘উত্তরাধিকার’-এর অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৮৮ সংখ্যায় তা প্রকাশিত হয়। এত বছর পর অনুবাদটি দেখতে গিয়ে মনে হ’ল নাটকটি একটু আবার ঠিক করি। এবার মাইকেল মেয়ার-এর অনুবাদের পাশাপাশি ওয়াল্টার ওয়াইকস্‌-এর রূপান্তরের সাহায্য নিলাম। সেই সাথে অধ্যাপক আলী আনোয়ার-এর ‘ইবসেন’ বইটিরও।—কল্যাণী রমা]

চরিত্র:
অধ্যাপক আর্নল্ড রুবেক (ইউরোপখ্যাত ভাস্কর, মধ্য-পঞ্চাশের ঘরে বয়স)
মায়া (তাঁর স্ত্রী, অপেক্ষাকৃত তরুণী, সুন্দরী, বয়স ত্রিশের কোঠায়)
ইনস্পেকটর
উল্‌ফহাইম (ভূস্বামী এবং ভালুক শিকারি)
একজন মহিলা পরিব্রাজক
নান
কয়েকজন ওয়েটার, হোটেলের অতিথি ও কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে
ঘটনাস্থল নরওয়ে। প্রথম অঙ্ক সমুদ্র সৈকতে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অঙ্ক পাহাড়ের কোলে এক স্যানাটোরিয়ামের কাছে।


প্রথম অঙ্ক
নরওয়ের উপকূলে খনিজ জলের জন্য বিখ্যাত এক ছোট শহর। শহরের একদিকে সমুদ্র, অন্যদিকে পাহাড়ের সারি। সেখানেই এক ছোট সুন্দর হোটেল। জায়গাটা খোলামেলা, পার্কের মত। মাঝে ফোয়ারা, ঝোপঝাড় ও বড় বড় সব পুরনো গাছ। বামে এক ছোট প্যাভিলিয়ন, বুনো আঙুর ও আইভিলতা দিয়ে ঢাকা। পিছনে সমুদ্রের খাঁড়ি দেখা যাচ্ছে। তার মাঝে দূরে ছোট দ্বীপ। গ্রীষ্মের এক শান্ত, উষ্ণ সকাল।

হোটেলের লনে বেতের চেয়ারে বসে আছেন অধ্যাপক ও তাঁর স্ত্রী মায়া। সামনে টেবিলের উপর খাবারের সাজ সরঞ্জামাদি। এইমাত্র খাওয়া শেষ হয়েছে। এখন পান করছেন শ্যাম্পেন আর সেল্‌ট্‌জার। দু’জনেরই হাতে খবরের কাগজ। অধ্যাপক প্রৌঢ়, সম্ভ্রান্ত চেহারা। গায়ে কালো ভেলভেটের জ্যাকেট। পরনে হালকা গ্রীষ্মকালীন পোষাক। মায়া রুবেকের বয়স অল্প, প্রাণবন্ত মুখ, উজ্জ্বল চোখ। কিন্তু তবু তাঁর মাঝে যেন এক ক্লান্তির ছোঁয়া। সুন্দর, রুচিশীল ভ্রমণের পোষাক পরে আছেন তিনি।
মায়া (অধ্যাপক কিছু বলবেন ভেবে মুহূর্তখানেক অপেক্ষা করে, তারপর খবরের কাগজটি নামিয়ে রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে)।


রুবেক: (তাঁর খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে) আচ্ছা মায়া, তোমার কি হয়েছে বল তো?

মায়া: নৈঃশব্দ! শুনতে পাচ্ছ?

রুবেক: (প্রশ্রয়ের হাসি হেসে) তুমি শুনতে পাচ্ছ?

মায়া: কি শোনার কথা বলছ?
রুবেক: নৈঃশব্দ।

মায়া: নিশ্চয়ই।

রুবেক: কি জানি, হবে হয়ত। সত্যিই হয়ত নৈঃশব্দ শোনা যায়।

মায়া: ঈশ্বর জানেন যে তা যায়। ঠিক যখন সে নৈঃশব্দ এই এখানকার মত কানে তালা লাগিয়ে দেয়-


রুবেক: এখানকার মত? এই স্পার কথা বলছ?

মায়া: হ্যাঁ, এই দেশটার সব জায়গাতেই তো। উফ্‌, শহরে এত যে শব্দ। কিন্তু এমন কি সেখানেও, আসলে ওই সমস্ত হৈ চৈ আর শব্দেরর ভিতরও কেমন যেন এক নিস্তব্ধতার ছোঁয়া আছে।

রুবেক: (তাঁর দিকে তাকান, একটু নির্দয় দৃষ্টিতে) আচ্ছা, বাসায় ফিরে এসে তুমি খুশি হওনি, মায়া?

মায়া: তুমি হয়েছ?

রুবেক: আমি?

মায়া: হ্যাঁ, তুমি। এতদি-ন বাইরে বাইরে ছিলে, আমার থেকে তো অনেক বেশি। তুমি কি সত্যিই আবার বাসায় ফিরে আসতে পেরে খুশি হয়েছ?

রুবেক: সত্যি বলতে কি, না। ঠিক খুশি হইনি।

মায়া: এখন দেখলে তো, এ আমি আগেই জানতাম।

রুবেক: কি জানি। হয়ত বাইরে, বাইরে খুব বেশি সময় কাটিয়ে ফেলেছি। এই উত্তর প্রদেশের জীবন কেমন যেন অপরিচিত লাগছে।

মায়া: (ব্যগ্রভাবে, নিজের চেয়ারটা রুবেকের দিকে টেনে নিয়ে) চল না, আবার বেরিয়ে পড়ি! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব!

রুবেক: (একটু অধৈর্য হয়ে) আমরা তো আবার বের হচ্ছিই মায়া। তুমি তো জানই।

মায়া: এখন কেন নয়? এই এক্ষুণি! ওখানে কত আরামে থাকব। আমাদের ওই নতুন, সুন্দর বাড়িটায়।

রুবেক: (আবার প্রশ্রয়ের হাসি হেসে) ‘আমাদের নতুন, সুন্দর বাসাটায়’ বললেই ভালো শোনাত নাকি?

মায়া: (কাঠখোট্টাভাবে) আমি ‘বাড়ি’ বলতেই বেশি পছন্দ করি। চল, বরং তাই বলি।

রুবেক: (মায়ার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকে) সত্যি, তুমি অদ্ভুত।

মায়া: খুব কি অদ্ভুত?

রুবেক: হুম, তাই তো মনে হয়।

মায়া: কেন? এখানে হেলাফেলায় সময় নষ্ট করতে চাই না বলে?

রুবেক: আচ্ছা, এবার গরমকালে উত্তরে আসতেই হবে বলে কে অত গোঁ ধরেছিল শুনি?

মায়া: কে জানে, হয়ত আমিই।

রুবেক: হ্যাঁ, আমি নিশ্চয়ই নয়।

মায়া: কিন্তু হায় ঈশ্বর, কিভাবে জানব যে সবকিছু এমন ভয়ানক বদলে যাবে? তাও এত তাড়াতাড়ি! মানে, এই তো মাত্র বছর চারেক হ’ল বাইরে গেছি-

রুবেক: তার মানে, তোমার বিয়ের পর থেকে।

মায়া: বিয়ে? তার সাথে এর কি সম্পর্ক?

রুবেক: (কথা চালিয়ে যেতে থাকে) যখন থেকে তুমি অধ্যাপকের স্ত্রী হয়েছ, একটা চমৎকার বাসার মালিক হয়েছ— ওহ্‌ হো, ভুল হয়ে গেছে— একটা চমৎকার বাড়ির মালিক হয়েছ। আর টনিৎজ হ্রদের ওপর একটা ভিলার। চারপাশ ঘিরে অসাধারণ সব লোকজন। বাড়িটা যে ভীষণ সুন্দর আর চমৎকার, তাতে কোন সন্দেহ নেই, মায়া। আর খুব বড়ও বটে। সবসময় গা ঘেঁষাঘেষি করে থাকতে হয় না—

মায়া: (কথাটা হালকাভাবে এড়িয়ে গিয়ে) না, না, প্রয়োজনের বেশি কোন ঘর তো নেই।

রুবেক: তা ঠিকই। আসলে তুমি আরও খোলামেলা আর বিলাসবহুল এক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছ। আর নিজ বাসায় যে জীবনে অভ্যস্ত ছিলে, তার থেকে অনেক সুন্দর এক সমাজে।

মায়া: ওহ্‌, তোমার ধারণা আমিই বদলে গেছি?

রুবেক: হ্যাঁ, মায়া, তুমিই।

মায়া: তার মানে এখানকার লোকগুলো নয়?

রুবেক: ওহ্‌ হ্যাঁ, ওরাও যে অল্পসল্প বদলে গেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে আরও ভালো কোন কিছুর জন্য বদলায় নি কেউ। সে আমি নিশ্চিত।

মায়া: তাও ভালো। শুনে খুশী হলাম।

রুবেক: (প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে) এখানকার লোকজন আর তাদের জীবন যখন দেখি, কোন কথাটা মনে পড়ে জানো?

মায়া: না, কি?

রুবেক: মনে পড়ে কন্টিনেন্ট থেকে ফিরবার পথে, ট্রেনে কাটানো সেই রাতটার কথা –

মায়া: তুমি তো সমস্তটা সময় ঘুমিয়েই ছিলে।

রুবেক: না, পুরোটা সময় ঘুমাই নি। ছোট, ছোট সব স্টেশনেই ট্রেনটা থামছিল। কি আশ্চর্য নিস্তব্ধ ছিল সব। তোমার মত আমিও তখন নৈঃশব্দের শব্দ শুনছিলাম, মায়া। একসময় খেয়াল হ’ল সীমান্ত পার হয়ে দেশে ঢুকে পড়েছি। বাড়ি যে এসে গেছে, বুঝতে পারলাম। কেননা পথের পাশের প্রত্যেকটা ছোট, ছোট স্টেশনে ট্রেনটা থামল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ – অথচ কেউ ওঠানামা করল না। কিছুই ঘটল না।

মায়া: তবে ট্রেনটা অমন থামছিল কেন?

রুবেক: কি জানি। কেউ নামেনি। কেউ ওঠেনি। তবু ট্রেনটা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকল। একদম চুপচাপ, মিনিটের পর মিনিট – যেন অনন্তকাল। আর প্রত্যেকটা স্টেশনেই দু’জন লোক প্ল্যাটফরম ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। ওদের একজনের হাতে লণ্ঠন। রাতের অন্ধকারে নিজেদের মধ্যে বিড়বিড় করে কি যেন বলছিল ওরা। খুব আস্তে, আস্তে। সুরহীন, অর্থহীন। গলার স্বরে ওঠাপড়া নেই। কোন উত্তেজনা নেই।

মায়া: হ্যাঁ, সব সময় দু’জন করে লোক। একসাথে হেঁটে যাচ্ছে, কথা বলছে – প্রত্যেকটা স্টেশনে।

রুবেক: অথচ কোন বিষয়বস্তু নেই সেইসব কথার। (গলার স্বর পরিবর্তন করে, বেশ উৎফুল্লভাবে) সে যা হোক, ওসব নিয়ে ভেব না। আমাদের তো কেবল কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তারপরই বড় স্টিমারটা তীরে ভিড়বে। আমরাও উপকূল ধরে ভাসতে শুরু করব – উত্তরে যেতে থাকব। যতদূর যাওয়া যায়— সুমেরু পর্যন্ত।

মায়া: সে যাব। কিন্তু তাহলে এই দেশটা আর তার লোকজন— কিছুই তো দেখা হবে না তোমার। অথচ সেজন্যই তুমি এসেছিলে।

রুবেক: (কাঠখোট্টাভাবে, বিরক্তিভরে) ওই সব যথেষ্ট দেখেছি।

মায়া: আচ্ছা, সমুদ্রে বেড়াতে গেলে কি বেশি ভালো লাগত তোমার?

রুবেক: তা সে তো সব সময়ই একটা পরিবর্তন বটে। তাই না?

মায়া: বেশ তো, তোমার যদি মনে হয় এতে তোমার ভালো হবে—

রুবেক: ভালো হবে? আমার? কেন, আমার তো কিছু হয়নি।

মায়া: (উঠে তাঁর কাছে যায়) হ্যাঁ, রুবেক। নিশ্চয়ই হয়েছে। আর সে তো তুমিও জানো।

রুবেক: তাই বুঝি? তবে বল, শুনি আমার কী হয়েছে?

মায়া: (রুবেকের চেয়ারের পিছনে ভর দিয়ে) তুমিই খুলে বল না। এত্ত অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ! যেন কোথাও শান্তি পাচ্ছ না। বাড়িতে না, অন্য কোথাও না। আর আজকাল কেমন যেন মানুষজনও এড়িয়ে, এড়িয়ে চলছ।

রুবেক: (একটু ব্যঙ্গের ছোঁয়াসহ) তাই নাকি? তুমি তাও লক্ষ্য করেছ?

মায়া: তোমাকে যারা চেনে, তারাই লক্ষ্য না করে তো পারবে না। আর সবচেয়ে দুঃখের কি জান? তুমি তোমার যে কাজ এত্ত ভালোবাসতে, তাও আর ভালোবাস না—

রুবেক: সেও খেয়াল করেছ?

মায়া: তুমি সবসময় কাজ করতে। দিনরাত—

রুবেক: তা সে এক সময় করতাম।

মায়া: কিন্তু যখন থেকে তোমার মাস্টারপিসটি শেষ করে ফেলেছ—

রুবেক: (চিন্তামগ্ন হয়ে মাথা নেড়ে) “পুনরুত্থানের দিন”।

মায়া: তোমার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম যা সারা পৃথিবীতে প্রদর্শিত হয়েছে, আর তোমাকে বিখ্যাত করেছে –

রুবেক: কি জানি, হয়ত সেখানেই ভুলের শুরু, মায়া।

মায়া: কী বলছ এসব?

রুবেক: যখন আমি আমার মাষ্টারপিসটি শেষ করে ফেললাম – (হাত নেড়ে, অনেক আবেগ গলার স্বরে) – “পুনরুত্থানের দিন” এক মহৎ শিল্পকর্ম। কিংবা হয়ত ছিল, যখন আমি প্রথম – না, না, এখনও তা আছে। নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই এ এক সেরা শিল্পকর্ম।

মায়া: (তাঁর দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে) হ্যাঁ রুবেক, সারা পৃথিবীই তো তা জানে।

রুবেক: সারা পৃথিবী কিছুই জানে না। কিছুই বোঝে না।

মায়া: অন্ততঃ তারা কিছু একটা তো অনুভব করতে পারে-

রুবেক: হ্যাঁ, পারে – কিন্তু এমন কিছু যার কোন অস্তিত্ব নেই। এমন কিছু যা আমি কখনো কল্পনা করিনি। আর তা নিয়েই তারা পাগল হয়ে ওঠে। (আপন মনেই গজরাতে থাকে) নিজেকে মৃতপ্রায় করে জনসাধারণকে খুশি করবার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রমের কি প্রয়োজন – হুজুগে সব লোকজনকে – “সারা পৃথিবীকে”?

মায়া: তাই বলে তুমি কি আরও কোন ভালো কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছ? অসংখ্য ‘বাস্ট’ তৈরি করছ আজকাল…তুমি কি সত্যিই মনে কর এইসব তোমার উপযুক্ত কাজ?

রুবেক: (ক্ষমাসুন্দর হাসি হেসে) মায়া, এইসব সাধারণ ‘বাস্ট’ নয়।

মায়া: সাধারণই, খুবই সাধারণ। এই গত দু’তিন বছর ধরে – যেদিন থেকে তুমি ওই বড় কাজটা শেষ করেছ-

রুবেক: তবু এগুলো সাধারণ প্রতিকৃতি নয়। বিশ্বাস কর।

মায়া: তবে এগুলো কি?

রুবেক: ওইসব মুখের মধ্যে বিশেষ একটা কিছু লুকিয়ে আছে। মুখগুলোর নিচে অন্য কোন মুখ, যা কেউ দেখতে পায় না।

মায়া: তাই নাকি?

রুবেক: কেবল আমি তা দেখতে পাই। আর এর ভিতর আমিই শুধু দারুণ আনন্দ খুঁজে পাই। বাইরে থেকে প্রতিকৃতিগুলো দেখে মূল মুখের সাথে ‘আশ্চর্য মিল’ আছে বলেই লোকের মনে হয়, আর তার দিকেই তারা মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু ওই মুখগুলোর নিচে আমি খোদাই করেছি আরো একটা করে ছবি – কোন না কোন জন্তু জানোয়ারের। আছে ঘোড়ার গম্ভীর, একনিষ্ঠ মুখ। গাধার একগুঁয়ে চোয়াল, কুতকুতে চোখের কান ঝোলা কুকুর, লম্বা নাকের থলথলে চর্বিওয়ালা শুয়োর, কতগুলো মূর্খ বর্বর চেহারার ষাঁড়।

মায়া: (উদাসীনভাবে) সবগুলোই কতগুলো নিরীহ, গৃহপালিত পশু। গোবেচারা।

রুবেক: কেবল কিছু নিরীহ, গৃহপালিত পশু, মায়া। সেইসব পশু যাদের মানুষ বিকৃত করেছে। নিজেদের নষ্ট মন দিয়ে, নিজেদের প্রতিচ্ছবিতে। আর প্রতিদানে পশুগুলোও আবার মানুষদেরই কলুষিত করেছে। (তাঁর গ্লাসের শ্যাম্পেনটুকু শেষ করে, হেসে) অথচ শিল্পের এইসব জালিয়াতি ভরা, ফরমায়েশি কাজের জন্যই শহুরে লোকগুলো আমাকে কমিশন করে। সরল বিশ্বাসে গুনে, গুনে নগদ টাকা দিয়ে যায়।

মায়া: (রুবেকের গ্লাস ভরে দেয় মায়া) তোমার লজ্জা হওয়া উচিত, রুবেক। নাও, এবার পান করে সুখী হও।

রুবেক: (নিজের কপাল কয়েকবার মুছে চেয়ারে হেলান দিয়ে) আমি সুখেই আছি, মায়া। সত্যিই সুখী। কোন একভাবে। (এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে) আসলে নিজেকে একদম সম্পূর্ণ মুক্ত আর স্বাধীন ভাববার মধ্যে এক ধরণের সুখ তো আছেই। আর সুখ আছে একটা জীবনে মানুষ যা যা চাইতে পারে, তার সবকিছু পেয়ে ফেলবার মধ্যে – যা কিছু স্থূল, সাংসারিক জীবনের সেই স-ব বস্তুগত সফলতা। তোমারও কি তেমনই মনে হয় না, মায়া?

মায়া: হ্যাঁ, তা হয়ত হয়। এইসব সাফল্যকে অস্বীকার করবার তো কোন উপায় নেই। (রুবেকের দিকে তাকিয়ে) কিন্তু তোমার কি মনে আছে সেই দিনটার কথা? আমরা যখন এই বন্দোবস্তে রাজি হয়েছিলাম, তুমি কী প্রতিজ্ঞা করেছিলে?

রুবেক: (মাথা নাড়ায়) একমত হয়েছিলাম যে আমাদের দু’জনের বিয়ে করা উচিত। তোমার জন্য তা একটু অসুবিধার হয়েছিল, তাই না, মায়া?

মায়া: (কথা চালিয়ে যায়) সেদিন তোমার সাথে বিদেশে পাড়ি জমানোর কথা ছিল আমার, কথা ছিল আনন্দে সেখানে থাকব।…মনে পড়ে, তখন তুমি কী প্রতিজ্ঞা করেছিলে?

রুবেক: (মাথা নেড়ে) আমিই যদি মনে করতে পারতাম তবে তো…! যাই হোক কি বলেছিলাম?

মায়া: বলেছিলে, আমাকে তুমি এক উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাবে, আর পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য দেখাবে।
রুবেক: (চমকে ওঠে) তোমার কাছেও এই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম?

মায়া: (রুবেকের দিকে তাকিয়ে) আমার কাছেও? তার মানে? আর কাকে বলেছিলে?

রুবেক: (হালকাভাবে) না, না, আমি কেবল বলতে চেয়েছি, আমি তোমাকে কী দেখাব বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম?

মায়া: পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য। হ্যাঁ, তুমি তাই বলেছিলে। আরো বলেছিলে ঐ সমস্ত সৌন্দর্য হবে তোমার আর আমার।

রুবেক: আসলে ওটা ছিল একটা কথার কথা, আমি অমন বলতে পছন্দ করতাম।

মায়া: কেবলই কথার কথা?

রুবেক: হ্যাঁ। সেই ছেলেবেলার স্কুলের দিনগুলো থেকেই আমি এমন বলতাম। যখনই মনে হ’ত অন্য বাচ্চারা এসে বনের ভিতর কিংবা পাহাড়ের চূড়ায় আমার সাথে একটু খেলুক। তখনই বলতাম এই কথা।

মায়া: কী জানি হয়ত সেজন্য আমাকেও তুমি চেয়েছিলে। শুধুই খেলা করবার জন্য।

রুবেক: (ঠাট্টা হিসাবে উড়িয়ে দিয়ে) তা সে যাই বল না কেন, মায়া। এ কিন্তু এক চমৎকার, মজাদার খেলা, তাই না?

মায়া: (শীতলভাবে) আমি তোমার সাথে বেরিয়ে পড়েছিলাম, তোমাকে বিয়ে করেছিলাম, শুধু এমন খেলা করে বেড়াবার জন্য নয়।

রুবেক: না, না, তেমন আমার ভাবাও উচিত না।

মায়া: কিন্তু তুমি তো আমাকে কোনদিন কোন পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাওনি। আমাকে দেখাতে…

রুবেক: (বিরক্তি ভরে)…পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য? না, নিয়ে যাইনি। আসলে সত্যি কথা বলতে কি মায়া, তুমি ঠিক পাহাড় বেয়ে উঠবার মত তো নও।

মায়া: (নিজেকে সংযত করবার চেষ্টা করে) একসময় কিন্তু তুমি ভাবতে যে আমি তেমনই।

রুবেক: চার কিংবা পাঁচ বছর আগে, হ্যাঁ (চেয়ারে হাত, পা টান করে) – চার, পাঁচ বছর। সে অনেক, অনেক দিন আগের কথা, মায়া।

মায়া: (রুবেকের দিকে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে) আচ্ছা রুবেক, তোমার কি সত্যিই মনে হয় এসব অনেক দিন আগের কথা?

রুবেক: না, এই আজকাল মনে হচ্ছে। (হাই তুলে) মাঝে, মাঝেই মনে হচ্ছে এমন।

মায়া: (নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে) ঠিক আছে, আর তোমাকে বিরক্ত করব না।

[মায়া চেয়ারে বসে। খবরের কাগজ তুলে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করে। নীরবতা দু’পক্ষেই। ]

রুবেক: (কনুই-এ ভর দিয়ে টেবিলের উপর ঝুঁকে মায়ার দিকে কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়) – প্রফেসরপত্নী অসন্তুষ্ট হয়েছেন নাকি?

মায়া: (শীতলভাবে, চোখ না তুলে) নাহ্‌, একটুও না।

[অতিথিরা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাঁদের বেশির ভাগ মহিলা। কেউ একা, একা; কেউ বা দল বেঁধে। পার্কের ভিতরে ডানদিক থেকে এসে বামদিক দিয়ে বেরিয়ে যায় ওরা। ওয়েটাররা হোটেল থেকে শরবত, জলখাবার ইত্যাদি বয়ে এনে প্যাভিলিয়নের দিকে যায়। ইনস্পেকটর বেড়ানো শেষ করে পার্কে আসে; হাতে গ্লাভস্‌ ও একটা ছড়ি। তিনি অতিথিদের সসম্মানে অভিবাদন করেন, তাঁদের কয়েকজনের সাথে দু’একটি কথা হয়।]

ইনস্পেকটর: (অধ্যাপক রুবেকের টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে, শ্রদ্ধাভরে টুপি নামিয়ে) ম্যাডাম, আপনাকে সুপ্রভাত জানিয়ে সম্মানিত হতে পারি কি? সুপ্রভাত, প্রফেসর!

রুবেক: সুপ্রভাত। সুপ্রভাত, ইনস্পেকটর।

ইনস্পেকটর: (মায়াকে সম্বোধন করে) আপনার রাতে ভাল ঘুম হয়েছিল তো?

মায়াঃ হ্যাঁ, চমৎকার। আমি সব সময়ই অঘোরে ঘুমাই।

ইনস্পেকটর: বাহ্‌, শুনে খুশী হ’লাম। নতুন বিছানায় কারো কারো তো প্রথম রাত ঘুমের চেষ্টাতেই কেটে যায়। আর অধ্যাপক আপনার?

রুবেক: নাহ্‌, আমার তো কখনই খুব একটা ভালো ঘুম হয় না। আজকাল তো আরো নয়।

ইনস্পেকটর: (সহানুভূতির দৃষ্টিতে) এতো একদম ভালো কথা না। কিন্তু দেখবেন, কয়েকটা সপ্তাহ আমাদের সাথে কাটালেই সব বদলে যাবে।

রুবেক: (তার দিকে তাকিয়ে) আচ্ছা বলুন তো, আপনাদের এখানে রাতে স্নান করবার অভ্যাস আছে, এমন কোন রোগী আছে নাকি?

ইনস্পেকটর: রাতের বেলা? না, কখনও তো এমন শুনিনি।

রুবেক: শোনেন নি?

ইনস্পেকটর: না, এখানে কেউ এত অসুস্থ বলে তো জানি না।

রুবেক: তবে এমন কি কেউ আছে যে রাতের বেলা পার্কে হেঁটে বেড়ায়?

ইনস্পেকটর: (হেসে মাথা নেড়ে) না প্রফেসর – তা’ এখানকার আইন বিরুদ্ধ।

মায়া: (অধৈর্য হ’য়ে) ঈশ্বরের দোহাই, রুবেক। তোমাকে আজ সকালে তো বলেইছি যে তুমি স্বপ্ন দেখছিলে।

রুবেক: (শুষ্কভাবে) তাই নাকি? আমি স্বপ্ন দেখছিলাম? ওভাবে ভাববার জন্য ধন্যবাদ। (ইনস্পেকটরের দিকে ফিরে) আসলে কাল রাতে ঘুম হচ্ছিল না। উঠে রাতটা কেমন তা দেখব ভাবলাম।

ইনস্পেকটর: আচ্ছা? তারপর?

রুবেক: জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি দূরে গাছপালার মাঝে যেন শাদা পোষাক পরা এক মানুষের মূর্তি।

মায়া: (ইনস্পেকটরের দিকে তাকিয়ে হেসে) আর প্রফেসর বলছেন যে ওই মূর্তিটি নাকি স্নানের পোষাক পরেছিল।

রুবেক: অথবা ওই ধরনের একটা কিছু। আমি খুব কাছ থেকে তো আর দেখতে পাইনি। শুধু শাদা রঙের কিছু একটা ছিল, এটুকুই বলতে পারি।

ইনস্পেকটর: আশ্চর্য! আচ্ছা, ওটা পুরুষ না নারী মূর্তি ছিল?

রুবেক: নারীর। সে আমি প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু ওই মূর্তির পিছনে আর কেউ যেন হেঁটে আসছিল। আর এই দ্বিতীয় মূর্তিটা ছিল বেশ অস্পষ্ট – ছায়ার মত –

ইনস্পেকটর: অস্পষ্ট মূর্তি? কালো?

রুবেক: হ্যাঁ, আমার তো তেমনই মনে হয়েছিল।

ইনস্পেকটর: (যেন ঘটনাটা বুঝতে শুরু করেছে এমনভাবে) আর হাঁটছিল শাদা মূর্তিটির পিছন পিছন? খুব কাছাকাছি?

রুবেক: হ্যাঁ, সামান্য একটু পিছনেই।

ইনস্পেকটর: ওহ্‌, তাহলে হয়ত প্রফেসর, আপনাকে এই রহস্যের একটা সমাধান দিতে পারি।

রুবেক: ঠিক আছে, বলুন – কে ওই নারী?

মায়া: (যুগপৎভাবে) – তার মানে, ও আসলে স্বপ্ন দেখছিল না?

ইনস্পেকটর: (ফিস্‌ফিস্‌ করে, স্টেজের পিছনে, ডানদিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে) শ্‌শ্‌, প্রফেসর! ওইদিকে দেখুন! আর একটু আস্তে, আস্তে কথা বলুন, প্লীজ।

[একজন হালকা-পাতলা গড়নের মহিলা চমৎকার ঘিয়ে রঙের কাশ্মিরী কাপড়ের পোষাক পরে হোটেলের দিক থেকে প্রবেশ করেন। পিছনে কালো পোষাক পরা একজন নান, তার বুকে চেনের সাথে রুপার একটা ক্রুশ ঝুলছে। মহিলাটি পার্কের মাঝ দিয়ে বামদিকে প্যাভিলিয়নের দিকে যায়। মুখ তার বিষণ্ন, নির্জীব-নিশ্চল যেন; অর্ধনিমীলিত চোখ আর তাতে শূন্যদৃষ্টি। পায়ের পাতা ছুঁয়ে আছে পোষাক। একটা বড় শাদা ভাঁজ, ভাঁজ ক্রেইপ শাল দিয়ে মাথা, ঘাড়, গলা, বাহু সব ঢাকা। বুকের কাছে হাত দু’টো ভাঁজ করা। হাত-পা শক্ত, নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে শরীরটা। তবু তাকেই টেনে টেনে নিয়ে চলেছে সে; মাপা মাপা নির্ভুল পদক্ষেপ। নানটিও মাপা মাপা পা ফেলে সাথে সাথেই। দেখে মনে হচ্ছে সে বুঝি মহিলাটির পরিচারিকা। নানের চোখগুলো তীক্ষ্ণ। বাদামি রঙের। সবসময় মহিলাটির উপর কড়া নজর রেখেই চলেছে নান। ওয়েটাররা হাতে ন্যাপকিন নিয়ে হোটেলের দরজার কাছে এসে উৎসুক হ’য়ে এই দুই অদ্ভুত মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু মহিলা দু’জন কোনদিকে লক্ষ্য না ক’রে, কারও দিকে না তাকিয়ে প্যাভিলিয়নের ভিতর ঢুকে যায়।]

রুবেক: (চেয়ার থেকে ধীরে ধীরে, অনিচ্ছাকৃতভাবে উঠে দাঁড়ায়। তারপর বন্ধ প্যাভিলিয়নের দরজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে) কে উনি?

ইনস্পেকটর: এখানে বেড়াতে এসেছেন। আর ওই যে ছোট প্যাভিলিয়নটি, ওটা ভাড়া নিয়েছেন।

রুবেক: বিদেশি বুঝি?

ইনস্পেকটর: আমার তো তাই মনে হয়। আর তা না হ’লেও ওনারা বাইরে থেকেই এসেছেন। প্রায় এক সপ্তাহ হ’ল। আর এখানে আগে কখনও আসেননি।

রুবেক: কালরাতে ওনাকেই পার্কে দেখেছিলাম।

ইনস্পেকটর: হ্যাঁ, তাই হবে। আপনার কথা শোনার সাথে, সাথে আমারও তেমনই মনে হয়েছিল।

রুবেক: ইনস্পেকটর, ভদ্রমহিলার নাম কি?

ইনস্পেকটর: উনি তো নাম লিখেছেন মাদাম দ্য সাটো ও তাঁর সঙ্গিনী বলে। এটুকুই আমরা জানি।

রুবেক: (কল্পনায় ভেসে গিয়ে) সাটো! সাটো!

মায়া: ওই নামের কাউকে চেন নাকি, রুবেক?

রুবেক: (মাথা নাড়িয়ে) নাহ্‌, চিনি না তো। সাটো! কেমন রুশী রুশী মনে হচ্ছে; কিংবা স্লাভ, তা সে যাই হোক। (ইনস্পেকটরের দিকে তাকিয়ে) আচ্ছা, উনি কোন ভাষায় কথা বলেন?

ইনস্পেকটর: ওনারা দু’জন যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলেন, তখন তা ঠিক বুঝতে পারি না। কিন্তু অন্যান্য সময় উনি খুব ভালো নরওয়েজিয়ান বলেন।

রুবেক: নরওয়েজিয়ান? আপনি ভুল করছেন নাতো?

ইনস্পেকটর: না, না, সে কি করে করি বলুন? আমি ভদ্রমহিলার সাথে বেশ কয়েকবার কথা বলেছি। যদিও কয়েকটা মাত্র শব্দ। আসলে উনি খুব কম কথা বলেন। কিন্তু –

রুবেক: কিন্তু উনি নরওয়েজিয়ান বলছিলেন?

ইনস্পেকটর: হ্যাঁ, চমৎকার, খাঁটি নরওয়েজিয়ান। হয়ত সামান্য একটু উত্তরের টান আছে কথায়।

রুবেকঃ (স্বগত) তাও!

মায়া: (অস্বস্তি ভরে এবং সামান্য আহত স্বরে) রুবেক, হয়ত কখনও উনি তোমার মডেল ছিলেন। ভেবে দেখ তো।

রুবেক: (তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মায়ার দিকে তাকিয়ে) মডেল?

মায়া: (ব্যঙ্গের সুরে) হ্যাঁ, যখন তোমার অল্প বয়স ছিল। সেইসব দিনে যারা তোমার মডেল ছিল, তাদের সকলের কথা মনে করে দেখ দেখি। মানে পুরানো দিনগুলোর কথা বলছি আর কি।

রুবেক: না মায়া, সত্যি বলতে কি, এ পর্যন্ত কেবল একজনই আমার মডেল ছিল। যা কিছু সৃষ্টি করেছি, তার সবকিছুর জন্যই – কেবল একজন মাত্র মডেল।

ইনস্পেকটর: (ঘুরে দাঁড়িয়ে দূরে বামদিকে তাকিয়ে) এখন উঠতে হচ্ছে বলে দুঃখিত। আসলে এমন কাউকে আসতে দেখছি, যার সাথে আমার কোন কথা না বলাই ভাল। বিশেষত একজন ভদ্রমহিলার সামনে।

রুবেক: (একই দিকে এক পলক দেখে) শিকারিটি কে?

ইনস্পেকটর: উল্‌ফহাইম। ভূস্বামী। এখানে এসেছেন-

রুবেক: ওহ্‌, উল্‌ফহাইম!

ইনস্পেকটর: ভালুকদের অত্যাচার করতেই ব্যস্ত। লোকে ওকে সেভাবেই জানে।

রুবেক: আমি ওনাকে চিনি।

ইনস্পেকটর: হ্যাঁ, সে কে আর না চেনে?

রুবেক: অবশ্য অল্প স্বল্প। তাহলে শেষ পর্যন্ত উনি এখানে আসলেন? চিকিৎসার জন্য নিশ্চয়ই?

ইনস্পেকটর: না। খুবই আশ্চর্য যদিও, তবু এখনও না। শুধু শিকারে যাওয়ার পথে বছরে একবার করে এই দিক দিয়ে ঘুরে যান। কিছু মনে করবেন না, আমি উঠছি। (হোটেলে যাওয়ার জন্য উঠে ঘুরে দাঁড়ায়)

উল্‌ফহাইম: (মঞ্চের বাইরে থেকে) আরে একটু থামুন! একটু থামুন! কী অদ্ভুত ব্যাপার! আমাকে দেখলেই আপনি সবসময় এমন তাড়াতাড়ি পালাতে যান কেন?

ইনস্পেকটর: (থেমে গিয়ে) না না! আমি মোটেও পালিয়ে যাচ্ছি না, মিঃ উল্‌ফহাইম।

(বামদিক থেকে উল্‌ফহাইম প্রবেশ করে। পিছনে এক পাল শিকারি কুকুর নিয়ে তাঁর ভৃত্য। উল্‌ফহাইমের পরনে শিকারি পোষাক – উঁচু বুটজুতা, আর মাথার ফেলট্‌ টুপিতে একটা পালক গোঁজা। লম্বা, পাতলা, বলিষ্ঠ শরীর। জট বাঁধা দাড়ি, চুল। চড়া গলার স্বর। চেহারা দেখে বয়স বোঝা মুশকিল হলেও বয়স তার অল্প নয়।)

উল্‌ফহাইম: (তীব্র ভর্ৎসনার সুরে, ইনস্পেকটরের উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে) অতিথিকে অভ্যর্থনা করবার এ আবার কোন ধরনের রীতি শুনি? একেবারে যে ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন? শয়তানে তাড়া করেছে বুঝি?

ইনস্পেকটর: (শান্তভাবে, প্রশ্নটি উপেক্ষা করে) আপনি কি স্টিমারে করে এসেছেন, স্যার?

উল্‌ফহাইম: (গর্জন করে ওঠে) নাহ্‌, কোথাকার কোন জাহান্নামের স্টিমার দেখবার সৌভাগ্য হয়নি আমার। (কোমরে হাত রেখে) আচ্ছা, আপনি কি জানেন না যে আমি সব সময় নিজের নৌকা করেই ঘুরে বেড়াই? (ভৃত্যের দিকে তাকিয়ে) তোর জাতভাই ওই জানোয়ারগুলোর ভালভাবে যত্ন নিস্‌, লারস্‌। তাই বলে বেশি বেশি মাংস দিস্‌ না যেন আবার। সবসময় আধ-পেটা রাখবি ওদের। তবে টাটকা মাংসের হাড় খেতে দিবি। আর খেয়াল রাখবি যেন তা থেকে কাঁচা, বোটকা গন্ধ বের হচ্ছে, গায়ে অনেক রক্ত-ও লেগে আছে। আর নিজের পেটেও কিছু দিস্‌। (ভৃত্যকে লাথি দেখিয়ে) ঠিক আছে যা, এখন ভাগ এখান থেকে।

[ভৃত্য কুকুরগুলো নিয়ে হোটেলের কোণ দিয়ে বের হয়ে যায়।]

ইনস্পেকটর: স্যার, রেস্টুরেন্টের ভিতরে যাবেন না?

উল্‌ফহাইমঃ কী? ওইসব মরা মাছি টাছি আর আধমরা মানুষজনের মধ্যে? নাহ্‌, ইনস্পেকটর। সে বরং থাক।

ইনস্পেকটর: ঠিক আছে, ঠিক আছে। সে যা আপনার খুশি।

উল্‌ফহাইম: শুধু হাউসকীপারকে একটু বলে দেবেন অন্যান্য বারের মতই আমার সব ব্যবস্থা করতে। দেখবেন খাওয়া-দাওয়া নিয়ে যেন আবার কোন কিপটামি না হয়। সবচেয়ে কড়া স্ক্যাণ্ডিনেভীয় মদটাও পাঠিয়ে দেবেন। হাউসকীপারকে আরো বলবেন যে আমি আর লারস্‌ ওর একদম দফা রফা করে ছাড়ব যদি না –

ইনস্পেকটর: (কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে) আপনি আগে যে এখানে থেকেছেন, তা থেকেই এইসব আমরা জানি। (ঘুরে) প্রফেসর, ওয়েটারকে কি বলব আপনাকে কিছু এনে দিতে? কিংবা হয়ত মিসেস রুবেকের জন্য কিছু একটা?

রুবেক: না, না, ধন্যবাদ। আমার কিছু লাগবে না।

মায়া: আমারও না।

[ইনস্পেকটর হোটেলের ভিতর ঢুকে যান।]

উল্‌ফহাইম: (রুবেক আর মায়ার দিকে এক মুহুর্ত কঠোর স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে, তারপর টুপি তুলে) মরণ আর কী! আমার মতো এক গেঁয়োভূত কিনা শেষে এনাদের সামনে এসে পড়ল!

রুবেক: (চোখ তুলে) কিছু বলছেন কি?

উল্‌ফহাইম: (আগের থেকে শান্ত ও বিনীতভাবে) বিখ্যাত ভাস্কর রুবেক না?

রুবেকঃ (মাথা নেড়ে) এদেশে গত যে শরৎকালটা কাটিয়েছি, বোধহয় তখন এক কি দু’বার আমাদের দেখা হয়েছে!

উল্‌ফহাইম: হ্যাঁ, কিন্তু সেতো বেশ কয়েক বছর আগের কথা; আর তখন আজকাল যেমন শুনি আপনি ঠিক ততটা বিখ্যাত ছিলেন না বলে একজন নোংরা ভালুক শিকারিও আপনার ত্রিসীমানায় আসতে সাহস করত।

রুবেক: (হেসে) আমি কিন্তু এখনও কামড়ে দেই না।

মায়া: (আগ্রহভরে উল্‌ফহাইমের দিকে তাকিয়ে) আপনি সত্যি সত্যি ভালুক শিকার করেন বুঝি?

উল্‌ফহাইম: (হোটেলের কাছাকাছি রুবেক ও মায়ার পাশের টেবিলটাতে বসে) ভালুকই বেশি পছন্দ করি, ম্যাডাম। কিন্তু ভালুক পাওয়া না গেলে পথের মাঝে বুনো যা কিছু পড়ে, তাতেই আমার কাজ চলে যায়। ঈগল, নেকড়ে, নারী, এল্‌ক্‌, বল্‌গা হরিণ – তাজা, রসালো।…আর যতক্ষণ পর্যন্ত এদের শিরায় বয়ে যাচ্ছে টকটকে লাল রক্ত। (হিপ-ফ্লাস্ক থেকে পান করে)

মায়া: (গভীর মনোযোগের সাথে তাকে লক্ষ্য করে) কিন্তু আপনি ভালুক শিকার করতেই বেশি পছন্দ করেন?

উল্‌ফহাইমঃ হ্যাঁ, সেটাই বেশি পছন্দ। কোন গড়বড় করলে অনায়াসেই ওদের পেটে ছুরি চালিয়ে দেওয়া যায়। (অল্প হেসে) আসলে কি জানেন ম্যাডাম, আপনার স্বামী আর আমি – আমরা দু’জনেই কঠিন জিনিষ নিয়ে কাজ করতে ভালবাসি। উনি মার্বেলের চাঙড় দিয়ে – মার্বেলই তো? আর আমি ভালুকের সতর্ক টানটান মাংসপেশি নিয়ে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত আমরা দু’জনই জয়ী হই। আর যতক্ষণ তা না হচ্ছে, হাল ছেড়ে দেই না। তা সে শিকার যত গোঁয়ার আর জেদিই হোক না কেন।

রুবেক: (ভেবে চিন্তে) তা সে একরকম ঠিকই বলেছেন।

উল্‌ফহাইম: হ্যাঁ, মৃত পাথরের ভিতর প্রাণ দেওয়া সে এক যুদ্ধ তো বটেই। মূর্তির ভিতর জীবন্ত হয়ে উঠবার আগে সব শক্তি দিয়েই তো বাধা দিয়ে যায় মার্বেল পাথর। ঠিক যেভাবে পাহাড় ভেঙ্গে উপরে উঠে গুহার ভিতর থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভালুক বের করতে হয় – তেমনই এক ব্যাপার।

মায়া: আপনি কি জঙ্গলে শিকার করবার জন্য পাহাড়ে যাচ্ছেন?

উল্‌ফহাইম: হ্যাঁ, পাহাড়ের বেশ উঁচুতে। আচ্ছা, মিসেস রুবেক, আপনি কখনও পাহাড়ে চড়েছেন?

মায়া: না, কখনও না।

উল্‌ফহাইম: হা কপাল! তাহলে এই গ্রীষ্মেই চলে আসুন না। আমার সাথেই না হয় চলুন। আমি খুব খুশি হয়েই আপনাদের দু’জনকে নিয়ে যাব।

মায়া: ধন্যবাদ। কিন্তু আমার স্বামী এই গ্রীষ্মে সমুদ্র-যাত্রার কথা ভাবছেন।

রুবেক: কেবল তীর বরাবর, দ্বীপগুলোর দিকে।

উল্‌ফহাইম: কেন শুধু শুধু ওইসব খানাখন্দের মধ্যে সময় নষ্ট করবেন? সত্যি এমন কথা কখনও শুনিনি – ডোবার জলে গরমকালটাকে নষ্ট করা। তাও আবার ডোবারও যা জল – একেবারে বাসন-ধোওয়া আর কি!

মায়া: রুবেক, শুনছ?

উল্‌ফহাইম: চলুন না, আমার সাথে পাহাড়ে চড়বেন। কোন লোকজন নেই ওখানে, একেবারে ফাঁকা। আর আমার কাছে সেটা যে কী ভীষণ দামি – কল্পনাও করতে পারবেন না। কিন্তু আপনার মত একজন ছোটখাট মানুষ, মিসেস – ! (উল্‌ফহাইম থামে। নানটি প্যাভিলিয়ন থেকে বের হয়ে হোটেলের ভিতর ঢুকে যায়। উল্‌ফহাইম তাকে চোখ দিয়ে অনুসরণ করে) – দেখেছেন কাণ্ডটা? কালো কাক একটা! কাকে কবর দেওয়া হচ্ছে আজ?

রুবেক: আমি ঠিক চিনি, এমন কাউকে তো না –

উল্‌ফহাইম: তবে নিশ্চয়ই খুব তাড়াতাড়িই কেউ পটল তুলবে। যে সব লোকজন নিজেদের সুস্থ রাখতে জানে না, তাদের খামোখা সময় নষ্ট না করে কবরে সেঁধিয়ে যাওয়াই উচিত।

মায়া: আপনার কি কোনদিন অসুখ-বিসুখ করেছে, মিঃ উল্‌ফহাইম?

উল্‌ফহাইম: নাহ্‌, কক্ষনো না। কোনদিন অসুখ-বিসুখ করলে আজ আর আমাকে এখানে বসে থাকতে হ’ত না। আমার প্রিয় বন্ধুরা অবশ্য বহুবার অসুখে পড়েছে।

মায়া: আর আপনি তাদের জন্য কি করেছেন?

উল্‌ফহাইম: সব কয়টাকেই গুলি করে খতম করে দিয়েছি।

রুবেক: (চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে) গুলি করেছেন?

মায়া: (নিজের চেয়ার পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে) গুলি করে মেরে ফেলেছেন?

উল্‌ফহাইম: (মাথা নেড়ে) ম্যাডাম, আমার তো কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।

মায়া: তাই বলে মানুষ মারবেন?

উল্‌ফহাইম: কী মুশকিল! মানুষের কথা আবার কে বলছে?

মায়া: কেন, আপনিই তো বলছিলেন! আপনার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুদের কথা।

উল্‌ফহাইম: সে তো আমার কুকুরগুলোর কথা বলছিলাম।

মায়া: ওরা আপনার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বুঝি?

উল্‌ফহাইম: হ্যাঁ, ওদের থেকে প্রিয় তো আর কেউ নেই। এত বিশ্বাসী আর প্রভুভক্ত। তবু যখনই ওদের কোন একটার অসুখ হয় কিংবা নিস্তেজ হ’তে শুরু করে – দুম্‌! ব্যস, শেষ! সোজা পরপার।

[নান হাতে ট্রে নিয়ে হোটেল থেকে বের হয়, ট্রের উপর দুধ আর রুটি, ট্রে-টি প্যাভিলিয়নের বাইরে টেবিলে রেখে প্যাভিলিয়নের ভিতর ঢুকে যায় আবার।]

উল্‌ফহাইম: (ঘৃণাভরে, ভীষণ বিদ্রুপের হাসি হাসতে হাসতে) ওই যে দেখুন, দেখুন! একে আপনারা মানুষের খাবার বলেন বুঝি? জল মিশানো দুধ, কবেকার বাসি নরম রুটি! আর আমার সঙ্গী-সাথিদের খাওয়া দেখবেন?

মায়া: (অধ্যাপকের দিকে তাকিয়ে হাসে আর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়) বেশ চলুন! দেখে আমি খুশিই হ’ব।

উল্‌ফহাইম: (সেও উঠে পড়ে) এই তো! এতক্ষণে একজন তেজি মহিলার মত কথাবার্তা! আসুন আমার সাথে। টকটকে লাল, বড় বড় মাংসের টুকরা আর হাড় – সব, সব ওরা এমন গবগব করে খায়! প্রথমে তো আস্ত গিলে ফেলে, তারপর খক্‌ করে তা মুখের ভিতর এনে ফেলে শেষমেশ সব আবার পেটের ভিতর। চলুন, দেখবেন চলুন। আর পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারেও কথা বলা যাবে-

[উল্‌ফহাইম উঠে হোটেলের কোণার দিক দিয়ে ঘুরে বেরিয়ে যায়। মায়া তার পিছন, পিছন। এক মুহূর্ত পর ওই অদ্ভুত মহিলাটি প্যাভিলিয়ন থেকে বেরিয়ে এসে নিজ টেবিলের সামনে বসে। দুধের গ্লাসটা তুলে দুধ খেতে যায়, এমন সময় দেখতে পায় রুবেককে। থেমে রুবেকের দিকে শূন্য, অভিব্যক্তিহীন চোখে তাকায়। রুবেক নিজ টেবিলেই বসে মহিলাটির দিকে সাগ্রহে ও গভীর মনোযোগের সাথে তাকিয়ে থাকে। তারপর উঠে মহিলাটির দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে থামে রুবেক। কোমলভাবে জিজ্ঞাসা করে -]

রুবেক: আইরিন না?

আইরিন: (উদাসীনভাবে তার গ্লাস নামিয়ে রেখে) চিনতে পেরেছ, আর্নল্ড?

রুবেক: তুমিও আমাকে চিনতে পেরেছ দেখছি।

আইরিন: সেটা আলাদা ব্যাপার।

রুবেক: কেন?

আইরিন: তুমি এখনও বেঁচে আছ।

রুবেক: বেঁচে আছি?

আইরিন: (কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে) তোমার টেবিলে যিনি বসেছিলেন, উনি কে?

রুবেক: ওর কথা বলছ? ও, ও – আমার স্ত্রী।

আইরিন: (আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে) তাই নাকি? চমৎকার আর্নল্ড! তবে তো এ ব্যাপারে আমার নাক গলানো উচিত নয়।

রুবেক: (অনিশ্চিতভাবে) না, উচিত নয়।

আইরিন: আমার মৃত্যুর পর কাউকে খুঁজে পেয়েছ তবে!

রুবেক: তোমার পরে – ? কী বলছ, আইরিন?

আইরিন: আর আমাদের সন্তান? ও ভালো আছে তো? আমার মৃত্যুর পরও তো ও বেঁচে আছে – বিখ্যাত হয়ে, সম্মানিত হয়ে।

রুবেক: (হাসে, তারপর বহুদিন আগের কোন স্মৃতিচারণ করছে, এমনভাবে বলে) আমাদের সন্তান। ও হ্যাঁ, তাই বলেই তো ওকে আমরা ডাকতাম। (উৎফুল্ল হতে চেষ্টা করে) হ্যাঁ আইরিন, এখন আমাদের সন্তান সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। তুমি ওর কথা পড়েছ নিশ্চয়ই।

আইরিন: (মাথা নেড়ে) আর ওর পিতাকে বিখ্যাত করেছে। তেমনই তো স্বপ্ন ছিল তোমার।

রুবেক: (শান্তভাবে, কিন্তু আবেগভরে) সবকিছুর জন্য আমি তোমার কাছে ঋণী, আইরিন, সবকিছুর জন্য। ধন্যবাদ তোমাকে।

আইরিন: (এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে বসে থাকে, তারপর বলে) যা করা উচিত ছিল তাই যদি করতে পারতাম, আর্নল্ড!

রুবেক: কি করতে?

আইরিন: আমি আমাদের ওই সন্তানকে হত্যা করতাম।

রুবেক: কী বললে? হত্যা করতে?

আইরিন: (ফিস্‌ ফিস্‌ করে) হ্যাঁ, তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার আগে ওকে হত্যা করতাম। সম্পূর্ণ ধ্বংস, চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলতাম।

রুবেক: তা তুমি কখনো করতে পারতে না, আইরিন। অতটা নিষ্ঠুর তুমি কিছুতেই হ’তে পারতে না।

আইরিন: হ্যাঁ, সেদিন অমন নিষ্ঠুর আমি ছিলাম না ঠিকই।

রুবেক: কিন্তু – পরে?

আইরিন: তারপরে আমি ওকে হাজার বার হত্যা করেছি। দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে। ওকে হত্যা করেছি ঘৃণায়, প্রতিহিংসায়, নিদারুণ যন্ত্রণায়।

রুবেক: (আইরিনের টেবিলের কাছাকাছি গিয়ে, মৃদুভাবে জিজ্ঞাসা করে) আইরিন, এতগুলো বছর পর আজ বলো তো, বলো তো সেদিন কেন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। কোন চিহ্ন না রেখে একেবারে উধাও হয়ে গিয়েছিলে – তোমাকে কোথাও আর খুঁজেই পেলাম না।

আইরিন; ওহ্‌ আর্নল্ড, এখন আর তা তোমাকে বলে কী হবে বল তো? – যখন আমিই মৃত?

রুবেক: তুমি কি অন্য কারো প্রেমে পড়েছিলে? এমন কেউ –

আইরিন: হ্যাঁ, এমন কেউ, আমার ভালোবাসার যার আর কোন প্রয়োজনই ছিল না। এমন কি প্রয়োজন ছিল না আমার জীবনেরও।

রুবেক: অতীতের কথা না হয় থাক। আচ্ছা, কোথায় ছিলে এতদিন, আইরিন? তোমাকে খোঁজার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেল?

আইরিন: আমি অন্ধকারের ভিতর হারিয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক যখন আমাদের সন্তান দাঁড়িয়েছিল আলোর মাঝে – মহিমান্বিত হয়ে।

রুবেক: তুমি এতদিন দেশ-বিদেশ ঘুরে কাটিয়েছ বুঝি?

আইরিন: হ্যাঁ, সে অনেক, অনেক দেশ।

রুবেক: (ধীরভাবে) আর কি কি করেছ?

আইরিন: দাঁড়াও, একটু ভাবতে দাও। ও হ্যাঁ, ক্যাবারেতে স্ট্রিপটিজ করেছি। মিউজিক হলগুলোতে টার্নটেবিলের উপর নগ্ন হয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি। পুরুষরা আমাকে দেখে উন্মাদ হয়ে যেত। প্রচুর টাকা করেছিলাম জানো। যা কিনা তোমার সাথে থাকতে একদম করতে পারি নি। তোমার তো কিছুই ছিল না আসলে। আর এমন সব পুরুষদের সাথে ছিলাম – যাদের আমি পাগল করে দিতে পারতাম, যা তোমাকে কোনদিন করে উঠতে পারিনি, আর্নল্ড। কী কঠিন আত্মসংযমই না ছিল তোমার!

রুবেক: তুমি বিয়েও তো করেছিলে, তাই না?

আইরিন: হ্যাঁ, তাদের একজনকে বিয়ে করেছিলাম।

রুবেক: তোমার স্বামী কি করেন?

আইরিন: ও দক্ষিণ আমেরিকায় একটা দেশের কূটনীতিবিদ ছিল। (শীতল হাসি হেসে) আমি ওকে পাগল করে ছেড়েছিলাম। ও উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল; বদ্ধ উন্মাদ! ওকে সারিয়ে তুলবার আর কোন পথই সামনে ছিল না। তবে যতদিন সম্পর্কটা টিকে ছিল, তা যথেষ্ট উপভোগ্য ছিল জানো!

রুবেক: উনি এখন কোথায়?

আইরিন: তা আছে কোন কবরের ভিতর হয়ত। উপরে চমৎকার এক বিরাট স্মৃতিসৌধ। আর মাথার খুলির ভিতর ঝন্‌ ঝন্‌ করছে সীসার বুলেট।

রুবেক: উনি আত্মহত্যা করেছিলেন?

আইরিন: হ্যাঁ। আমাকে সব ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়ে ও যথেষ্ট দয়ার পরিচয় দিয়ে গেছে।

রুবেক: ওঁর মৃত্যুতে তুমি কি দুঃখিত নও, আইরিন?

আইরিন: কে মৃত বলে দুঃখিত হব?

রুবেক: হের ফন সাটো।

আইরিন: ওর নাম সাটো ছিল না।

রুবেক: তবে?

আইরিন: আমার দ্বিতীয় স্বামীর নাম সাটো। ও রুশী।

রুবেকঃ এখন উনি কোথায়?

আইরিন: বহু দূরে, উরাল পর্বতে, ওর সোনার খনিতে।

রুবেক: উনি ওখানে থাকেন বুঝি?

আইরিনঃ (কাঁধ ঝাঁকিয়ে) ওখানে থাকে মানে? তোমার ধারণা ও জীবিত? মনে হয় ওকেও আমি হত্যা করেছি।

রুবেক: হত্যা করেছ?

আইরিন: এক সূক্ষ্ণ, ধারালো ছোরা দিয়ে। সবসময় বিছানায় ওই ছোরা নিয়ে ঘুমাতে যাই আমি।

রুবেক: তোমার কথা বিশ্বাস হয় না, আইরিন!

আইরিন: (মৃদু হেসে) এ কথা সত্যি, আর্নল্ড, তোমাকে ছুঁয়ে বলছি।

রুবেক: (সহানুভূতির সুরে) তোমার কোনদিন সন্তানাদি হয়নি?

আইরিন: হ্যাঁ, অনেক, অনেক সন্তান।

রুবেক: ওরা কোথায় এখন?

আইরিন: আমি ওদেরও হত্যা করেছি।

রুবেক: (কড়াভাবে) আবার তুমি মিথ্যা কথা বলতে শুরু করেছ।

আইরিন: বলছি ওদের আমি হত্যা করেছি। এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে। ওরা যে মুহূর্তে পৃথিবীতে এসেছে, তৎক্ষণাৎ। না, তারও আগে, তারও বহু, বহু আগে। একজন, একজন করে।

রুবেক: তোমার সব কথারই যেন অন্য একটা কোন অর্থ আছে।

আইরিন: এ ছাড়া আমার আর তো কোন উপায় নেই, আর্নল্ড। তোমাকে যা কিছু বলছি, তার প্রতিটি শব্দই কেউ যেন আমার কানে, কানে বলে যাচ্ছে।

রুবেক: আর হয়ত আমিই একমাত্র মানুষ যে সেই অর্থ বুঝতে পারছে।

আইরিন: একমাত্র তোমারই তো পারা উচিত।

রুবেক: (টেবিলের উপর হাত দু’টো রেখে, আইরিনের চোখের গভীরে তাকিয়ে) তোমার ভিতরে কোন একটা তার ছিঁড়ে গেছে, আইরিন।

আইরিন: (শান্তভাবে) যখন কেউ মারা যায়, তেমনই কি সবসময় হয় না?

রুবেক: উফ্‌ আইরিন, এসব অদ্ভুত চিন্তা অনেক হয়েছে। তুমি বেঁচে আছ, বেঁচে আছ, বেঁচে আছ!

আইরিন: (ধীরে ধীরে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়; থরথর করে কাঁপতে, কাঁপতে) আমি বহু বছর ধরে মৃত ছিলাম। ওরা এসেছিল। আমাকে বেঁধে ফেলেছিল। ‘স্ট্রেইট-জ্যাকেটে’ পিছমোড়া করে। তারপর নামিয়ে দিয়েছিল কবরের ভিতর – মানসিক হাসপাতালের শব্দহীন ঘরে। দরজায় এঁটে দিয়েছিল লোহার খিল। আর দেয়ালগুলো এমনভাবে মুড়ে দিয়েছিল যে উপর থেকে কেউ যেন মৃতের তীক্ষ্ণ চীৎকার শুনতে না পায়। কিন্তু এখন, ধীরে ধীরে আমি মৃত্যুর মাঝ থেকে জেগে উঠছি । (আবার বসে পড়ে)

রুবেক: (এক মুহূর্ত পর) তুমি কি এজন্য আমাকে দোষী মনে কর? আমাকে অপরাধী ভাব? আমাকে দায়ী কর, আইরিন?

আইরিন: হ্যাঁ।

রুবেক: অপরাধী – তুমি যাকে মৃত্যু বলছ তার জন্য?

আইরিন: তুমি দোষী – কেননা তুমি আমার জন্য কোন ভবিষ্যৎ নয়, রেখে গেছ কেবল মৃত্যু। (গলার স্বর পরিবর্তন করে, বেশ সাধারণভাবে) আর্নল্ড, একটু বসবে তো?

রুবেক: (চেয়ার টেনে এনে টেবিলের সামনে এসে বসে) দেখ আইরিন, পুরনো দিনগুলোতে যেভাবে বসে থাকতাম, এখন ঠিক সেভাবে বসে আছি।

আইরিন: একটু দূরত্ব রেখে; পুরনো দিনগুলোতেও যেমন।

রুবেক: (আরও কাছে সরে এসে) তখন যে তার দরকার ছিল, আইরিন!

আইরিন: দরকার ছিল?

রুবেক: আমাদের মাঝে একটু দূরত্ব থাকা প্রয়োজন ছিল।

আইরিন: সত্যিই কি তার খুব দরকার ছিল, আর্নল্ড?

রুবেক: আচ্ছা, মনে আছে তোমার? বাড়ি-ঘর ছেড়ে বাইরের পৃথিবীতে আমার সাথে বেরিয়ে আসবে কিনা জিজ্ঞাসা করায় কী বলেছিলে তুমি?

আইরিন: আমি তিনটা আঙ্গুল তুলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম – তোমার সাথে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যাব; যাব জীবনেরও শেষ পর্যন্ত। আর সবকিছুতে তোমাকে সাহায্য করব-

রুবেক: আমার সৃষ্টির জন্য মডেল হ’য়ে।

আইরিন: স্বাধীন এবং নগ্ন-

রুবেক: তুমি সত্যিই আমাকে সাহায্য করেছিলে, আইরিন – আনন্দের সাথে, খুশিমনে, অকৃপণভাবে-

আইরিন: হ্যাঁ, আমার যৌবনের সমস্ত টগবগে ফুটন্ত রক্ত দিয়ে।

রুবেক: সত্যি, কী ভীষণ সত্যি।

আইরিন: (হাত মুঠো করে রুবেকের দিকে এগিয়ে গিয়ে) আমি তোমার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে তোমার সেবা করেছি, আর্নল্ড। কিন্তু তুমি – তুমি – তুমি -!

রুবেক: আমি কখনো তোমার ক্ষতি করিনি। কখনো না, আইরিন।

আইরিন: হ্যাঁ, করেছ! তুমি আমার অন্তরতম আত্মার ক্ষতি করেছ।

রুবেক: আমি?

আইরিন: হ্যাঁ, তুমি। তুমি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে বলে, কেবল তাকিয়ে থাকবে বলে, আমায় তোমার জন্য নগ্ন করেছ। (আরও শান্তভাবে) – অথচ তুমি, তুমি কখনও আমাকে একবার স্পর্শ পর্যন্ত করনি।

রুবেক: আইরিন, তুমি কি বোঝনি যে তোমার সৌন্দর্য বহুবার আমাকে প্রায় পাগল করে দিয়েছিল?

আইরিন: অথচ তুমি যদি আমাকে স্পর্শ করতে, হয়ত সাথে সাথেই তোমাকে হত্যা করতাম। আমি একটা তীক্ষ্ণ শলাকা সবসময় চুলের আড়ালে লুকিয়ে রাখতাম। (বিষণ্নভাবে কপাল মুছে) হ্যাঁ, কিন্তু – কিন্তু, না, না! তুমি কেমন করে তা পারলে?

রুবেক: আমি এক শিল্পী ছিলাম, আইরিন।

আইরিন: একজন শিল্পী, হ্যাঁ, তাই তো।

রুবেক: সবকিছুর আগে, আমি তো এক শিল্পীই। আর সেই সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা – আমার জীবনের মহৎ সৃষ্টিটা করবার প্রবল কামনায় আমি প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, আইরিন। (স্বপ্ন ও স্মৃতির মাঝে হারিয়ে গিয়ে) …”পুনরুত্থানের দিন” – এমনই নাম হওয়ার কথা ছিল। এক যুবতী – মৃত্যুর ঘুম থেকে যেন জেগে উঠছে – এভাবেই তাকে আমি কল্পনা করেছিলাম।

আইরিন: আমাদের সন্তান, হ্যাঁ।

রুবেক: ওই যে জেগে উঠছে মেয়েটি – সে হবে যা কিছু মহান, যা কিছু পবিত্র সব দিয়ে তৈরী; নারীর সমস্ত পূর্ণতায়। ঠিক তখন আমি তোমাকে পেয়েছিলাম। যা কিছু প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম, তার সবকিছুই দেখতে পেয়েছিলাম তোমার মধ্যে। আর তুমিও এত আনন্দে, এত স্বেচ্ছায় রাজি হয়ে গিয়েছিলে যে তুমি তোমার পরিবার, বাড়িঘর সবকিছু ছেড়ে আমার সাথে বেরিয়ে এসেছিলে।

আইরিন: যখন তুমি আমাকে বাইরে নিয়ে এলে আমার মনে হয়েছিল আমি যেন আবার একটা ছোট্ট মেয়ে হয়ে গিয়েছি।

রুবেক: সেজন্যই তোমাকে ব্যবহার করতে পেরেছিলাম, আইরিন। কেবল তোমাকে, আর কাউকে নয়। আমার কাছে তুমি ছিলে এমন কিছু যা ভীষণ পবিত্র। যাকে ছোঁয়া যায় না, কেবল উপাসনা করা যায়। আইরিন, তখন আমার বয়সও অল্প ছিল। আর কেমন যেন স্থির বিশ্বাস জন্মেছিল যে যদি তোমাকে আমি স্পর্শ করি, যদি ভোগের জন্য কামনা করি, আমার কল্পনা অপবিত্র হয়ে যাবে। আর তাহলে যার জন্য এমন কঠিন এক যুদ্ধ করে চলেছি, যা পেতে চাইছি, তা কখনও আর পাব না। আমি এখনও বিশ্বাস করি অমনভাবে চিন্তা করবার ভিতর কিছুটা হলেও যেন সত্য ছিল।

আইরিন: প্রথমে আত্মার সন্তান; তারপর দেহের।

রুবেক: যদি চাও আমাকে দোষী কর। কিন্তু – তখন আমার কাজ সম্পূর্ণভাবেই আমাকে প্রভাবিত করে রেখেছিল। আর কী প্রচণ্ড আনন্দেই না আমি তাতে ডুবে গিয়েছিলাম।

আইরিনঃ তুমি সফলও হয়েছিলে, আর্নল্ড।

রুবেক: হ্যাঁ, তা হয়েছিলাম। তোমার জন্য, তোমার জন্যই তা পেরেছিলাম, আইরিন। পুনুরুত্থানের দিনে জেগে উঠবার পর ঠিক যেমন দেখাবে, ঠিক তেমন এক নারী আমি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলাম – পবিত্র, অকলঙ্কিত। যা কিছু নতুন, অজানা, অকল্পনীয় তার প্রতি বিস্ময়ে অভিভূত নয়, কিন্তু মৃত্যুর দীর্ঘ স্বপ্নহীন ঘুমের পর, এক আরও মহৎ, বন্ধনহীন, সুখী রাজ্যের মাঝে নিজেকে অপরিবর্তিত রূপে খুঁজে পেয়ে – এক পবিত্র আনন্দে পরিপূর্ণ সে যে এক নশ্বর নারী! (শান্তভাবে) এভাবেই তাকে আমি সৃষ্টি করেছিলাম – তোমারই প্রতিচ্ছবিতে, আইরিন।

আইরিন: (অলসভাবে হাত দু’টো টেবিলের উপর রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে) আর ঠিক তখনই তোমার সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিল।

রুবেক: আইরিন!

আইরিন: তোমার কাছে আমার আর কোন প্রয়োজন ছিল না-

রুবেক: কী বলছ এসব?

আইরিনঃ তুমি আসলে তোমাকে অনুপ্রাণিত করতে পারে এমন অন্য আর কিছু খুঁজতে শুরু করেছিলে-

রুবেক: তোমার পর আমি আর কাউকেই খুঁজে পাইনি।

আইরিন: অন্য আর কোন মডেলই নয়, আর্নল্ড?

রুবেক: তুমি শুধু একজন মডেলই তো ছিলে না। তুমি ছিলে আমার অনুপ্রেরণা।

আইরিন: (এক মুহুর্ত পর) সেই যেদিন তোমাকে ছেড়ে এসেছি, তারপর থেকে তুমি আর কি কি কবিতা লিখেছ? মানে মার্বেলে খোদাই করে?

রুবেক: সেদিন থেকে আর কোন কবিতা লিখি নি। খুব সাধারণ, তুচ্ছ কিছু খোদাই করে বছরগুলো আমি নষ্ট করেছি, আইরিন।

আইরিন: আর এখন যার সাথে আছ –

রুবেক: (রূঢ়ভাবে) এখন ওর কথা বল না।

আইরিন: তুমি তার সাথে কোথায় যাওয়ার কথা ভাবছ?

রুবেক: (ক্লান্তভাবে) উত্তরের উপকূল ধরে এক দীর্ঘ, ক্লান্তিকর প্রমোদ-ভ্রমণে।

আইরিন: (রুবেকের দিকে তাকিয়ে, প্রায় অদৃশ্য এক হাসি দিয়ে, ফিস্‌ ফিস্‌ করে বলে উঠবে) পাহাড় বেয়ে উঠে যাও, আর্নল্ড, যত উঁচুতে যাওয়া যায়। উঁচুতে – অনেক, অনেক উঁচুতে।

রুবেক: তুমি যাচ্ছ সেখানে?

আইরিন: আবার আমার সাথে দেখা করবার সাহস হবে তোমার?

রুবেক: শুধু যদি পারতাম! কেবল যদি পারতাম!

আইরিন: কেন পারব না? যদি আমরা চাই? এস, এস, আর্নল্ড, পাহাড়ে উঠে এস। আমার কাছে এস –

[ মায়া হোটেলের কোণার দিক থেকে আসে। খুশিতে উজ্জ্বল মুখ, তাড়াহুড়া করে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায়, যেখানে সে আর রুবেক আগে বসেছিল।]

মায়া: তুমি যা-খুশি বলতে পার, রুবেক, কিন্তু – (আইরিনকে দেখে থেমে যাবে) – ওহ্‌, নতুন কারো সাথে পরিচিত হয়েছ দেখছি।

রুবেক: (সংক্ষিপ্তভাবে) আমি একজন পূর্ব পরিচিতকে খুঁজে পেয়েছি। (উঠে দাঁড়িয়ে) তা কি বলছিলে?

মায়া: বলছিলাম, তোমার যা-খুশি বলতে পার, কিন্তু ওই বিশ্রী ষ্টিমারে করে আমি তোমার সাথে কোথাও কিন্তু যাচ্ছি না।

রুবেক: কেন?

মায়া: আমি পাহাড়ের উপরে, বনের মাঝে যেতে চাই। ওইসব আমার অনেক বেশি ভাল লাগবে। (মিনতি ভরা কণ্ঠে) ওহ্‌ রুবেক, আমাকে তোমার যেতে দিতেই হবে। কী ভীষণ খুশিই যে হব যদি যেতে দাও!

রুবেক: তোমাকে কে এইসব বুদ্ধি দিয়েছে?

মায়া: ওই যে সেই ভয়ংকর লোকটা। ভালুক মারে যে। উফ্‌ তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, পাহাড় সম্বন্ধে এমন সব চমৎকার আর অসাধারণ সব কথা বলছিল না ও। আর সেখানকার জীবন! ও না এত ভয়ানক আর ভয়ের সব গল্প তৈরি করছিল – আমি ঠিক জানি যে ওগুলো শুধুই গল্প – কিন্তু তবু তাই এমন আশ্চর্যরকম আর আকর্ষণীয় শোনাচ্ছিল। আচ্ছা, আমি ওর সাথে যাই? শুধু ও যা যা বলছে তা সত্যি কিনা দেখতে? যাই, রুবেক?

রুবেক: যেখানে ইচ্ছে যাও, যতদিন খুশি থাক গিয়ে। হয়ত আমি নিজেও ওদিকেই যাচ্ছি।

মায়া: (তাড়াতাড়ি) না, না, তোমার আর কষ্ট করে আসতে হবে না। আমার জন্য খামোখা কোন কষ্ট করতে হবে না।

রুবেক: কিন্তু আমিও পাহাড়েই যেতে চাই। এখন তেমনই মন স্থির করেছি।

মায়া: ওহ্‌, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ তোমাকে, রুবেক! (রুবেকের হাতগুলো নিজের হাতের ভিতর নিতে চেষ্টা করে, কিন্তু রুবেক তা সরিয়ে নেয়) ইস্‌, তুমি কী ভালো, রুবেক! আজ যে কী ভীষণ ভালো ব্যবহার করছ!

[মায়া হোটেলের ভিতর দৌড়ে যায়। ঠিক সেই সময় প্যাভিলিয়নের দরজাটা আস্তে, আস্তে অল্প খুলে যায়, নিঃশব্দে। দরজার ভিতরে নান দাঁড়িয়ে। সে তাদের লক্ষ্য করতে থাকে। তারা যদিও তাকে দেখতে পায় না।]

রুবেক: (আইরিনের দিকে ফিরে) তবে আমাদের কি ওখানে দেখা হবে?

আইরিন: (ধীরে, ধীরে উঠে) হ্যাঁ, সেখানে আমরা মিলিত হব। সেই কবে থেকে আমি তোমাকে খুঁজে ফিরছি।
রুবেক: কবে থেকে, আইরিন?

আইরিন: (বিদ্রূপের হাসি হেসে) ঠিক যখন থেকে আমি বুঝতে পারলাম, আমি তোমাকে এমন কিছু দিয়ে ফেলেছি যা ছাড়া আমি আর চলতে পারব না, আর্নল্ড। এমন কিছু যা কখনও কারো কাছ ছাড়া করতে নেই।

রুবেক: (মাথা নীচু করে) হ্যাঁ, তা ভয়ানক সত্যি। তুমি আমাকে তোমার যৌবনের চারটি বছর দিয়েছিলে।
আইরিন: তার চেয়েও বেশি! আমি তোমাকে তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়েছিলাম। আসলে আমি খুব বেশি বেহিসাবী ছিলাম।

রুবেক: হ্যাঁ, তুমি সত্যিই বেহিসাবী ছিলে আইরিন, তোমার সমস্ত নগ্ন সৌন্দর্য তুমি আমাকে দিয়েছিলে –

আইরিন: চেয়ে থাকবার জন্য।

রুবেক: আর অমর করে রাখবার জন্য।

আইরিন: তোমার একার গর্ব আর মহিমার জন্য। আর আমাদের সন্তানের জন্য।

রুবেক: তোমার জন্যও, আইরিন।

আইরিন: আমি তোমাকে সবচেয়ে দামি যে উপহারটি দিয়েছিলাম, তার কথা তুমি ভুলে গেছ!

রুবেক: সবচেয়ে দামি-? কিসের কথা বলছ?

আইরিন: তোমাকে আমার আত্মাটি দিয়েছিলাম – তরুণ আর জীবন্ত। তারপর নিজে – রিক্ত, সত্তাহীন। তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছ না? তাই তো আমার মৃত্যু হ’ল, আর্নল্ড।

[নান দরজাটি সম্পূর্ণ খুলে আইরিনের জন্য সরে দাঁড়ায়। আর আইরিন প্যাভিলিয়নের মাঝে ঢুকে যায়।]
রুবেক: (আইরিনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তারপর ফিস্‌ ফিস্‌ করে বলে ওঠে) আইরিন!

চলবে…